পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় পেশির টান বা আঘাতের কারণে হয়ে থাকে। ভারী কিছু
তোলা, ভুল ভঙ্গিতে বসা বা হঠাৎ শরীর মোচড়ানোয় পেশিতে চাপ পড়ে এবং সেই জায়গায়
ব্যথা সৃষ্টি হয়। কখনও দীর্ঘ সময় এক ভঙ্গিতে কাজ করলে বা ঘুমের সময় ভুলভাবে
শোওয়ার ফলেও এই ব্যথা হতে পারে।
সাধারণত এই ব্যথা কয়েকদিন বিশ্রাম, হালকা গরম সেঁক ও সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখলে
কমে যায়। তবে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, কারণ এটি
মেরুদণ্ড বা স্নায়ুর সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম ও সঠিকভাবে
বসার অভ্যাস পিঠের ব্যথা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
২. দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিমায় বসে থাকা
পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিমায় বসে থাকার কারণে হয়।
বিশেষ করে যারা অফিসে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে কাজ করেন বা টানা বসে
থাকেন, তাদের পিঠের পেশিতে চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে ব্যথা তৈরি হয়। কম্পিউটারে
কাজ, মোবাইল ব্যবহার, বা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর সময় আমরা প্রায়ই ভুল
ভঙ্গিমায় বসে থাকি, যা আমাদের মেরুদন্ডে চাপ ফেলে।
একই ভঙ্গিতে বসে থাকলে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে পেশি শক্ত ও ক্লান্ত
হয়ে পড়ে। নিয়মিত বিরতি না নেওয়া, সঠিকভাবে চেয়ারে না বসা এবং শরীর নড়াচড়া না
করা এ সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তােলে। তাই প্রতি এক ঘণ্টা পরপর উঠে হাঁটা বা
স্ট্রেচিং করা উচিত।
সঠিক বসার ভঙ্গি বজায় রাখা ও হালকা ব্যায়াম পিঠের মাঝখানে ব্যথা
অনেকাংশে প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৩. মেরুদণ্ডে ডিস্কজনিত সমস্যা
পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় মেরুদণ্ডে ডিস্কজনিত সমস্যার কারণে হয়ে থাকে।
আমাদের মেরুদণ্ডে ছোট ছোট হাড়ের মাঝে নরম ডিস্ক থাকে, যা চলাফেরা ধকল সহ্য
করে ও মেরুদণ্ডকে নমনীয় রাখে। কোনো কারণে এই ডিস্ক সরে গেলে বা চাপে পড়লে
আশেপাশের স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং ব্যথা শুরু হয়।
এতে পিঠের মাঝখানে বা নিচের অংশে টান ধরার মতো ব্যথা অনুভূত হয়, কখনও হাত
পায়েও ঝিনঝিন ভাব হতে পারে। দীর্ঘ সময় ভুলভাবে বসা, ভারী জিনিস তোলা বা
বয়সজনিত কারণে এ সমস্যা দেখা দেয়। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক অঙ্গভঙ্গিতে চলাফেরা
বসা এসব অভ্যাস বজায় রাখলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এ ব্যথা কমানো
সম্ভব।
৪. আর্থ্রাইটিস (Arthritis)
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হাড়ের জোড়াগুলো ক্ষয় হতে থাকে। ফলে পিঠে ব্যথা হতে
পারে। পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টের প্রদাহের কারণে
হয়। আর্থ্রাইটিসে মেরুদণ্ডের হাড়ের সংযোগস্থলে প্রদাহ দেখা দেয়, ফলে পেশি
শক্ত হয়ে যায় ও নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়।
এই ব্যথা সকালে বেশি অনুভূত হয় এবং বিশ্রামের পরও কমে না। বয়স বাড়া, পুরোনো
আঘাত বা জেনেটিক কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে পিঠে
ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়ে এবং স্বাভাবিক কাজকর্মে ও চলাফেরায়
অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গিমায় উঠাবসা চলাফেরা করলে ও চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ।
৫. স্কোলিওসিস বা মেরুদণ্ড বাঁকা হওয়া
জন্মগতভাবে বা পরে মেরুদণ্ড বাঁকা হলে পিঠের মাঝখানে অনেক সময় ব্যথা হতে পারে
। স্কোলিওসিস হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে মেরুদণ্ড সোজা না থেকে একদিকে বাঁক
নেয়, ফলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং পেশিতে চাপ পড়ে ফলে এই অবস্থায় পিঠের
মাঝখানে টান ধরা, ব্যথা বা ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে।
অনেক সময় এটি জন্মগত কারণে হয়, আবার কারও ক্ষেত্রে ভুল ভঙ্গিতে বসা বা
দাঁড়ানোর অভ্যাস থেকেও তৈরি হয়। স্কোলিওসিস গুরুতর হলে শ্বাসকষ্ট বা চলাফেরায়
অসুবিধা দেখা দিতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ভঙ্গিমায় চলাফেরা এবং
চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এ ব্যথা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
৬. অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যা
পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় শুধুমাত্র পেশি বা হাড়ের কারণে নয়, অভ্যন্তরীণ
অঙ্গের সমস্যার ফলেও হতে পারে। যেমন হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, কিডনি বা পেটের
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনো সমস্যা থাকলে সেই ব্যথা পিঠের মাঝখানে অনুভূত হতে
পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কিডনিতে পাথর, ফুসফুসে সংক্রমণ বা হার্টের সমস্যা থেকেও এই
ব্যথা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ব্যথা সাধারণত স্থায়ী হয় এবং ওষুধ বা বিশ্রামে
সহজে কমে না। কখনও সঙ্গে জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা বমি ভাবের মতো উপসর্গও থাকতে
পারে।
তাই এমন ব্যথা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, যাতে আসল
কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে হূৎপিণ্ড, ফুসফুস বা
কিডনির সমস্যা থেকেও এধরণের ব্যথা হতে পারে।
৭.
স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তা
মানসিক চাপ পেশিতে টান সৃষ্টি করে, যা পিঠে ব্যথা তৈরি করতে পারে। পিঠের
মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় শারীরিক নয়, মানসিক কারণেও হতে পারে। স্ট্রেস ও
দুশ্চিন্তা থাকলে শরীরের পেশিগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টান টান হয়ে যায়,
ফলে পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনুভূত হয়। দীর্ঘদিন মানসিক চাপ থাকলে ঘুম কমে যায়,
শরীর ক্লান্ত লাগে এবং ব্যথা আরও বাড়ে।
যারা কাজের চাপ বা মানসিক উদ্বেগে ভোগেন, তাদের মধ্যে এই ধরনের ব্যথা বেশি
দেখা যায়। নিয়মিত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম, হালকা ব্যায়াম ও মনকে শান্ত রাখার
চর্চা যেমন ধ্যান বা গভীর শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস এ ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
৮.
অতিরিক্ত ব্যায়াম বা ভুল ব্যায়ামের কৌশল
পিঠের মাঝখানে ব্যথা অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যায়াম করা বা ভুলভাবে ব্যায়াম করার
কারণে হয়ে থাকে। যখন কেউ শরীরকে অতিরিক্ত চাপ দেয় বা সঠিক ভঙ্গি মেনে ব্যায়াম
না করে, তখন পিঠের পেশি ও মেরুদণ্ডে টান পড়ে। ফলে ব্যথা, শক্তভাব বা ফোলা
অনুভব হতে পারে।
বিশেষ করে ভারোত্তোলন বা কঠিন ব্যায়াম করার সময় ভুল কৌশল ব্যবহার করলে এই
সমস্যা বেশি দেখা যায়। ব্যায়ামের আগে শরীর গরম না করা বা স্ট্রেচিং না করাও
ঝুঁকি বাড়ায়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে, ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ানো
উচিত।
ব্যথা হলে বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জিমে বা বাড়িতে অনিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম thoracic অংশে চাপ ফেলতে পারে।
কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
নিচের যেকোনো একটি লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন
-
ব্যথা ক্রমাগত বাড়ছে
-
রাতে ঘুমের মধ্যে ব্যথা তীব্র হয়
-
জ্বর, ওজন হ্রাস বা দুর্বলতা অনুভব করছেন
-
পেশিতে অসাড়তা বা হাত-পায়ে ঝিনঝিনে ভাব
-
দুর্ঘটনার পর ব্যথা শুরু হয়েছে
ঘরোয়া প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনা
১. বিশ্রাম ও সঠিক ঘুমের ভঙ্গিমা
পিঠের মাঝখানের ব্যথা দূর করতে বিশ্রাম ও সঠিক ঘুমের ভঙ্গিমা খুব
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত কাজ বা চাপের কারণে পেশিতে টান পড়লে
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, যাতে পেশি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ঘুমানোর সময় ভুল ভঙ্গিতে শোওয়া, যেমন খুব নরম বা শক্ত বিছানায় ঘুমানো, ব্যথা
আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। পিঠের ব্যথা কমাতে মাঝারি শক্ত বিছানায় চিত হয়ে বা
পাশে কাত হয়ে ঘুমানো ভালো। বালিশ যেন খুব উঁচু বা নিচু না হয়, তা খেয়াল রাখতে
হবে।
নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম ও সঠিক ঘুমের ভঙ্গিমা মেনে চললে পিঠের ব্যথা
অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ২–৩ দিন বিশ্রাম নিন তবে দীর্ঘদিন শুয়ে থাকা
ঠিক নয়। ঘুমানোর সময় কাঁধ ও কোমর সোজা রাখার চেষ্টা করুন।
২. হট বা কোল্ড কমপ্রেস
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে হট বা কোল্ড কমপ্রেস খুব কার্যকর একটি উপায়। যদি
ব্যথা হঠাৎ আঘাত, পেশির টান বা ফোলাভাবের কারণে হয়, তাহলে ঠান্ডা সেঁক বা
কোল্ড কমপ্রেস দেওয়া ভালো। এটি ফোলাভাব কমায় ও ব্যথা প্রশমিত করে। আবার
যদি ব্যথা দীর্ঘদিনের হয় বা পেশি শক্ত হয়ে যায়, তাহলে গরম সেঁক বা হট কমপ্রেস
দেওয়া উপকারী।
এটি রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে পেশিকে শিথিল করে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। দিনে
১৫-২০ মিনিট করে কয়েকবার হালকা গরম বা ঠান্ডা সেঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়। তবে
অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা ব্যবহার না করাই ভালো, যাতে ত্বকে ক্ষতি না হয়।
৩. হালকা স্ট্রেচিং ও যোগব্যায়াম
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে হালকা স্ট্রেচিং ও যোগব্যায়াম খুব কার্যকর।
নিয়মিত হালকা স্ট্রেচিং করলে পেশি শিথিল হয়, রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং পিঠের টান
কমে। যোগব্যায়ামের মাধ্যমে পিঠের পেশি ও মেরুদণ্ড দৃঢ় হয়, শরীরের ভারসাম্য
বজায় থাকে এবং ব্যথা কমে।
বিশেষ করে ক্যাট-কাউ স্ট্রেচ, কোবরা পোজ বা
শিশু পোজের মতো সহজ যোগব্যায়াম পিঠের জন্য উপকারী। প্রতিদিন মাত্র
১০-১৫ মিনিট স্ট্রেচিং ও যোগব্যায়াম করলে পিঠের পেশি শক্তিশালী হয় এবং ব্যথার
পুনরাবৃত্তি কমে। ব্যথা থাকলেও ধীরে ধীরে ও সাবধানে ব্যায়াম করা উচিত, যাতে
কোনো ক্ষতি না হয়।
৪. সঠিক অঙ্গবিন্যাস (Posture) বজায় রাখা
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে সঠিক অঙ্গবিন্যাস বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক সময় ভুলভাবে বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটা পিঠের পেশিতে চাপ সৃষ্টি করে, যা
ব্যথার কারণ হয়। কাজের সময় চেয়ারে সোজা বসা, পায়ের গোড়ালি মাটিতে রাখা এবং
কম্পিউটারের স্ক্রিন চোখের উচ্চতায় রাখা ভালো।
দাঁড়ানোর সময় পিঠ সোজা রাখা ও ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। ভারী জিনিস তোলার সময়
পিঠ নয়, হাঁটুর শক্তি ব্যবহার করা উচিত। সঠিক অঙ্গবিন্যাস নিয়মিত মেনে চললে
পেশি শিথিল থাকে, মেরুদণ্ড সুরক্ষিত থাকে এবং পিঠের মাঝখানের ব্যথা অনেকটাই
কমে।
৫. ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে ওভার দ্য কাউন্টার (OTC) ওষুধ অনেক সময় সহায়ক হতে
পারে। সাধারণত পেশি শিথিল করা বা ব্যথা কমানোর জন্য পেইনকিলার ওষুধ পাওয়া
যায়, যা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াও ব্যবহার করা যায়। যেমন প্যারাসিটামল বা
কিছু অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
ওষুধ নেওয়ার আগে ব্যবহার নির্দেশিকা ভালোভাবে পড়া জরুরি, যাতে অতিরিক্ত ডোজ
বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হয়। তবে শুধুমাত্র ওষুধে ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা
যথেষ্ট নয়; বিশ্রাম, সঠিক ভঙ্গি, হালকা ব্যায়াম ও প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের
পরামর্শ নিতে হবে।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন ও প্রতিরোধ
নিয়মিত ব্যায়াম
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন
হালকা স্ট্রেচিং, হাঁটা, বা যোগব্যায়াম করলে পিঠের পেশিগুলো শক্ত ও নমনীয়
থাকে। এতে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যায়। বিশেষ করে
“ক্যাট-কাউ”, “চাইল্ড পোজ” বা “ব্রিজ এক্সারসাইজ” করলে পিঠের চাপ কমে ও আরাম
পাওয়া যায়।
তবে ব্যায়াম করার সময় অতিরিক্ত জোর দেওয়া উচিত নয়। নিয়মিত ও ধীরে ধীরে
ব্যায়াম করলে পিঠের ব্যথা কমার পাশাপাশি শরীরও ফিট থাকে। তাই প্রতিদিন কিছু
সময় ব্যায়ামে দিলে পিঠের মাঝখানের ব্যথা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। প্রতিদিন ৩০
মিনিট হালকা হাঁটা, সাঁতার বা যোগব্যায়াম পিঠের পেশিকে শক্তিশালী করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। অতিরিক্ত ওজন
হলে পিঠের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে, ফলে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও
নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন ঠিক রাখলে পেশি ও হাড়ের ভারসাম্য বজায়
থাকে। চর্বিযুক্ত ও ফাস্টফুড খাবার কমিয়ে ফল, শাকসবজি ও পানি বেশি খাওয়া
উচিত।
ওজন কমলে পিঠের চাপ কমে এবং নড়াচড়া সহজ হয়। এছাড়া সঠিক ভঙ্গিতে বসা ও হাঁটার
অভ্যাস গড়ে তুললে পিঠের ব্যথা ধীরে ধীরে কমে যায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
খুবই প্রয়োজন। অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডে চাপ ফেলে, তাই স্বাস্থ্যকর ডায়েট গ্রহণ
করুন।
ভার তোলার সময় সতর্ক থাকা
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে ভারী কিছু তোলার সময় সতর্ক থাকা খুব জরুরি। অনেক
সময় ভুলভাবে ভারী জিনিস তোলার কারণে পিঠে চাপ পড়ে এবং ব্যথা বেড়ে যায়।
ভারী জিনিস তোলার সময় কোমর বাঁকানো নয়, বরং হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হয়ে
তুলতে হবে। ভারী কিছু তুললে একসাথে না তুলে ভাগ করে তোলা ভালো। পিঠ সোজা রেখে
ভার তোলা এবং শরীর ঘুরিয়ে ভার তোলার অভ্যাস এড়িয়ে চলা উচিত।
এছাড়া প্রতিবার ভার তোলার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া ভালো। সঠিক পদ্ধতিতে ভার
তোলা পিঠের পেশিকে সুরক্ষা দেয় এবং ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমায়। ভারী
কিছু তোলার সময় হাঁটু ভেঙে বসুন এবং কোমরের পরিবর্তে পায়ের শক্তি
ব্যবহার করুন।
মানসিক চাপ কমানো
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে মানসিক চাপ কমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত
মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা শরীরের পেশিকে টানটান করে ফেলে, ফলে পিঠে ব্যথা
বাড়ে। তাই মানসিক চাপ কমাতে মনকে শান্ত রাখতে নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া, পর্যাপ্ত
ঘুমানো এবং পছন্দের কাজ করা দরকার। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময়
কাটালে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
মানসিকভাবে শান্ত থাকলে শরীরের ব্যথাও দ্রুত কমে যায়। তাই পিঠের ব্যথা কমাতে
মানসিক স্বস্তি বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। ধ্যান, মেডিটেশন ও পর্যাপ্ত ঘুম
মানসিক চাপ কমিয়ে পেশিতে শিথিলতা আনে। ধ্যান, প্রার্থনা বা হালকা সংগীত শুনলে
মানসিক প্রশান্তি আসে। ইতিবাচকভাবে চিন্তা করলে মন ভালো থাকে ।
ভুল ধারণা ও সতর্কতা
পিঠের মাঝখানের ব্যথা অনেকেরই সাধারণ সমস্যা, কিন্তু এ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা
আছে। অনেকে মনে করেন সম্পূর্ণ বিশ্রামই একমাত্র সমাধান, আসলে হালকা ব্যায়াম ও
সঠিক অঙ্গভঙ্গি ব্যথা কমাতে বেশি সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা
সেঁক ক্ষতি করতে পারে।
ভারি জিনিস তোলার সময় হঠাৎ ঝুঁকে না পড়ে হাঁটু ভেঙে তুলতে হয়। দীর্ঘ সময়
মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহারেও পিঠে চাপ পড়ে, তাই নিয়মিত বিরতি নেওয়া জরুরি।
ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে
নিরাপদ উপায়।
চিকিৎসা পদ্ধতি (যদি ঘরোয়া উপায়ে না কমে)
ফিজিওথেরাপি
পিঠের মাঝখানের ব্যথা কমাতে ফিজিওথেরাপি একটি কার্যকর ও নিরাপদ উপায়। এটি
ব্যথার মূল কারণ শনাক্ত করে ব্যায়াম, স্ট্রেচিং ও সঠিক অঙ্গভঙ্গি ও চলাফেরা
শেখানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্যথা কমানোর ব্যবস্থা করেন। ফিজিওথেরাপিস্টরা
পেশি শক্তিশালী করতে এবং জয়েন্টের নমনীয়তা বাড়াতে বিশেষ অনুশীলন করিয়ে থাকেন।
কখনও হালকা গরম বা ঠান্ডা সেঁক, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি বা ম্যাসাজও ব্যবহার
করা হয় ব্যথা কমানোর জন্য। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি করলে পিঠের ব্যথা পুনরায় হওয়ার
ঝুঁকি কমে যায়। তাই ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে ওষুধের ওপর নির্ভর না করে অভিজ্ঞ
ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
এক্স-রে বা MRI
পিঠের মাঝখানের ব্যথা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে বা খুব বেশি হলে এক্স-রে বা এমআরআই
(MRI) করানো প্রয়োজন হতে পারে। এক্স-রে হাড়ের গঠন, ভাঙা বা বাঁকা থাকার
সমস্যা দেখায়, আর এমআরআই পেশি, স্নায়ু ও ডিস্কের বিস্তারিত অবস্থা বোঝাতে
সাহায্য করে।
এতে চিকিৎসক ব্যথার সঠিক কারণ যেমন ডিস্ক স্লিপ, নার্ভ চাপা পড়া বা প্রদাহ
নির্ণয় করতে পারেন। তবে হালকা ব্যথায় অযথা এক্স-রে বা এমআরআই না করাই ভালো।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব পরীক্ষা করালে ভুল ধারণা বা অপ্রয়োজনীয় ভয় তৈরি
হতে পারে।
ইনজেকশন বা ওষুধ
পিঠের মাঝখানের ব্যথা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ইনজেকশন বা ওষুধ
ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত ব্যথা কমানোর ওষুধ, প্রদাহনাশক ও মাংসপেশি
শিথিলকারী ওষুধ দেওয়া হয়। অনেক সময় নার্ভে চাপ থাকলে কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন
দেওয়া হয়, যা প্রদাহ কমিয়ে ব্যথা উপশমে সাহায্য করে।
তবে এসব ওষুধ বা ইনজেকশন সাময়িক স্বস্তি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এর উপর নির্ভর করা
ঠিক নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়।
ফিজিওথেরাপি, হালকা ব্যায়াম, সঠিক অঙ্গভঙ্গি ও চলাফেরা ব্যথা কমানোর
স্থায়ী সমাধান। তবে চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী স্টেরয়েড ইনজেকশন বা নির্দিষ্ট
ওষুধ দিতে পারেন।
উপসংহার
পিঠের মাঝখানে ব্যথা একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা অবহেলা করলে
দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করতে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামান্য কিছু পরিবর্তন
যেমন চলাফেরা ঠিক রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, এবং মানসিক চাপ
কমানো গেলে এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যদি ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা অন্যান্য জটিল
উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে নিজে থেকে চিকিৎসা না করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ
নেওয়াই শ্রেয়।
স্মার্ট ইনফো ডেস্কের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্টের রিভিউ করা হয়। নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url